★গ্রন্থ আলোচনা★★ ” সিলটি কথ্য ভাষার অভিধান”এবং কিছু কথা// মিলন কান্তি দাস

প্রকাশিত: ৮:১০ পূর্বাহ্ণ, জুন ১৩, ২০২৫

★গ্রন্থ আলোচনা★★  ” সিলটি কথ্য ভাষার অভিধান”এবং কিছু কথা// মিলন কান্তি দাস

এই পৃথিবীতে রয়েছে অসংখ্য ভাষা।
রয়েছে উপভাষা,আঞ্চলিক ভাষা।কারো কারো রয়েছে একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু শব্দ–যা আর পৃথিবীর কোথাও,কারো কাছে নেই।মানুষ এমন এক জাতি, যে তার ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে।প্রকাশ করে তার আবেগ, অনুভূতি।প্রকাশ করে তার সৃজনশীলতা।তবে মানুষ সবচেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে তার মাতৃভাষায়।যে ভাষাটা সে তার মাতৃগর্ভ থেকে শুনে শুনে পৃথিবীতে ভূমিষ্ট হয,মানুষ সে ভাষাতেই কথা বলতে,মনের ভাব প্রকাশ করতে,আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।মানুষের মাতৃভাষা সাধারনত আঞ্চলিক ভাষা হয়ে থাকে।মাতৃভাষাটা কখনো পুরো জাতির ভাষা হয়ে উঠেনা।মাতৃভাষাটা একটি অঞ্চলের ভাষা হয়।সেই অঞ্চল বা সেই জনপদের মানুষ এই ভাষাতেই কথা বলতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।একজন মানুষ পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক না কেন,সে তার মাতৃভাষার প্রতি সবসময়ই অনুভূতিশীল ও আবেগ পরায়ন হয়ে থাকে।

আমরা সিলেটি।বাংলাদেশের একখন্ড ভূখন্ড নিয়ে আমাদের এই সিলেট।এই সিলেটেরও একটি নিজস্ব ভাষা রয়েছে।যেটা সিলেটবাসী হিসাবে আমাদের নিকট গৌরবের।আমাদের সিলেটি ভাষাটা মূলত আমাদের সিলেট অঞ্চল,ভারতের আসাম রাজ্যের করিমগঞ্জ,শিলচর এলাকা,ভারতের মনিপুর রাজ্যের কিছু অংশের,ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কিছু অংশের এবং মেঘালয় রাজ্যের কিছু অংশের মানুষের দৈনন্দিন কথ্যভাষার প্রধান ভাষা। সিলেটি ভাষাকে কথ্য ভাষা,আঞ্চলিক ভাষা,উপভাষা,স্বাধীন ভাষা–এরকম অনেক নামে ভাষাবিদরা অভিহিত করেছেন। তবে যে যে নামেই আখ্যায়িত করুক না কেন,সিলেটি ভাষা যে একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ ভাষা,তা যুগ যুগ ধরে প্রমাণিত।সিলেটি ভাষা একটি আত্ম সমৃদ্ধ ভাষা,যার পুরোপুরি নিজস্বতা রয়েছে।রয়েছে তার নিজস্ব বর্ণমালা যা নাগরী লিপি নামে পরিচিত।নাগরী লিপির ব্যবহার এখন দৃশ্যমান না হলেও নাগরী বর্ণমালা এখনো সংরক্ষিত রয়েছে গবেষণা পর্যায়ে ভাষা সংরক্ষণের প্রয়োজনে।সিলেটি ভাষায় পৃথিবীর এক কোটিরও বেশী মানুষ কথা বলে–যা অবাক হওয়ার মত মনে হলেও বাস্তব সত্য এটাই।

পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেমন সম্মানের, পৃথিবীর প্রতিটি ভাষাও তেমনি সম্মানের। আমি,আপনি যে ভাষাতেই কথা বলি না কেন,অন্য যেকোন ভাষাকেই আমাদের সম্মানের চোখে দেখতে হবে।তবেই আমরা পরিশুদ্ধ মানুষ।আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।বাংলা ভাষা পুরো জাতির প্রাণ হলে সিলেটি ভাষাটি আমাদের প্রাণের স্পন্দন।যেটাকে বাদ দিয়ে আমরা বাংলা ভাষাকে তথা আমাদের নিজস্বতাকে কল্পনাই করতে পারিনা।

সিলেটি ভাষায় নিয়মিত নাটক তৈরী হচ্ছে।মানুষ তা টেলিভিশনে দেখছে এবং চিত্ত বিনোদনের খোরাক হিসাবে এসব নাটক মানুষের হৃদয়ে দোলা দিয়ে চলেছে।সিলেটি ভাষায় নিয়মিত রচিত হচ্ছে সিলেটি ছড়া।সিলেটের অনেক ছড়াকার সিলেটি ভাষায় ছড়া লিখে চলেছেন নিয়মিত।এই ছড়াগুলো যেমন পাঠক সমাজের পাঠ্যাভ্যাসে গতিশীলতা এনেছে,ঠিক তেমনি আমাদের এই প্রাণের ভাষাটিকে সংরক্ষণেও ভূমিকা রাখছে।আমাদের এই ভাষাটি আমাদের ঐতিহ্য,আমাদের গর্বের ধন।এই ভাষাটিকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের।আমাদের দ্বারাই আমাদের এই ভাষাটি টিকে থাকবে অনন্ত অসীমকাল।তবে সেক্ষেত্রে সমাজের সাধারন মানুষের পাশাপাশি আমাদের জ্ঞান অনিসন্ধিৎসু শ্রেণীকে বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে।আমরা জানি,আমাদের সিলেটের অনেক কবি,সাহিত্যিক,গবেষক,ভাষাবিদ রয়েছেন–যারা নিয়মিত এই ভাষার হয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।যে কাজগুলো আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সংরক্ষিত হয়ে থাকবে।

ঠিক এরকমই কাজে সদা আত্মনিয়োগ করে যাচ্ছেন গবেষক মোহাম্মদ মোশতাক চৌধুরী, যিনি পেশাগত জীবনে একজন উচ্চপদস্থ ব্যাংক কর্মকর্তা হওয়া সত্বেও মাটির টানে,নাড়ির টানে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন।লিখার প্রয়োজনে ছুটে চলছেন সিলেট হতে সুনামগঞ্জ,মৌলভীবাজার হতে হবিগঞ্জ।সাধারন মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে চলেছেন।তথ্যবহুল লেখা দিয়ে সমৃদ্ধ করে চলেছেন তার সকল গ্রন্থ।

গবেষক মোহাম্মদ মোশতাক চৌধুরী পেশায় ব্যাংকার হলেও মননে শতভাগ পরিশুদ্ধ এক সাহিত্য গবেষক।এ পর্যন্ত তার যতগুলো বই প্রকাশিত হয়েছে,তার প্রায় সবকয়টিই গবেষণাধর্মী।যা আমাদের সিলেট অঞ্চল সহ ভারতের আসাম রাজ্যের বরাক উপত্যকায় পাঠকের মনে স্বতস্ফুর্তভাবে সাড়া দিয়েছে।

গবেষক মোহাম্মদ মোশতাক চৌধুরীর সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থের নাম–“সিলটি কথ্য ভাষার অভিধান”।গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে সিলেটের জনপ্রিয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান পান্ডুলিপি।গ্রন্থটি এবারের একুশের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে।গ্রন্থটি সিলেটি শব্দের ভান্ডারের। অর্থাৎ সিলেটের মানুষের মুখের ভাষায় প্রচলিত সকল শব্দের প্রমিত বাংলায় আভিধানিক অর্থ নিরূপন করা।মোশতাক চৌধুরী এই অতীব জরুরী কাজটি করেছেন এবং অতি যত্ন সহকারে নিরলস পরিশ্রম করে সম্পাদনা করেছেন।সাথে তুলে ধরেছেন সিলেটের প্রচলিত কিছু ছিল্লক।সিলেটি ছিল্লকগুলি খুবই শ্রুতিমধুর।কালের বিবর্তনে এই ছিল্লকগুলির অনেকগুলিই আজ হারতে বসেছে।ঠিক সেই ছিল্লকগুলিই গবেষক মোশতাক চৌধুরী অত্যন্ত যত্ন সহকারে তুলে ধরেছেন।যেগুলো অনেকের কাছে হয়তো সহজই মনে হবে,কিন্তু বাস্তবতা অনেক কঠিন।অনেক শ্রম ও সাধনার সমন্বয়ে এরকম কাজ করতে হয়।গবেষক মোশতাক চৌধুরী ঠিক সেভাবেই কাজটি করেছেন একজন দায়িত্বশীল গবেষকের ন্যায়–বইটি পড়ে আমার তা-ই মনে হয়েছে। একজন দায়িত্বশীল,পরিশ্রমী লেখকের গবেষণাধর্মী বই আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্যের দলিল–যা ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বকীয়তা,নিজস্বতা ও অস্থিত্ব ঐতিহ্য রক্ষার্থে সহায়ক হবে।

বইটির শুরুতেই গ্রন্থপ্রণেতা চমৎকার একটি ভূমিকা লিখেছেন। লেখকের এই ভূমিকা থেকে শিকড়ের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়। চাকুরী তার ব্যাংকে,কিন্তু শিকড় তার অস্হি মজ্জায়।শত ব্যাস্ততার মাঝেও সিলেট নিয়ে লেখকের নিত্য ভাবনায় লেখকের মননশীল হৃদয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়।সিলেট নিয়ে অনেকে অনেক কাজ করেছেন,করছেন এবং ভবিষ্যতে করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি।তবে সিলেটি অভিধান নিয়ে কোন কাজ আমার কাছে এই প্রথম বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।এর আগে সিলেটি অভিধান নিয়ে কোন কাজ হয়ে থাকলে তা আমার জানার মধ্যে নেই। তাই বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা নির্ণয়ের অভিধান হিসাবে এই গ্রন্থটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি এবং আরে গুরুত্বপূর্ণ আমাদের প্রজন্মের প্রয়োজনে।প্রজন্ম হতে প্রজেন্মে মোশতাক চৌধুরী রচিত অভিধানটি সিলেটি কথ্য ভাষার সঠিক দলিল হয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বেঁচে থাকুক–এই শুভ প্রত্যাশা রইলো।